ইউক্রেন সংকট: ইউক্রেনের যে ঘটনাগুলি আলোচনায়
সম্প্রতি ইউক্রেন জটিলতা কে কেন্দ্র করে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি আজ নতুন নয়। ১৯২২ সালে বলশেভিকদের হাত ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময় রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর ছায়া যুদ্ধ চালিয়েছে।
রাশিয়ার কাছে উত্তর ইউরোপীয় সমভূমি, ককেশাস, মধ্য এশিয়া এবং চীনা সীমান্ত সবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাশিয়ার জন্য এখন কেন্দ্রীয় ইস্যু ইউক্রেন।
ইউক্রেনে বহুদলীয় রাজনীতির প্রভাব বিদ্যামান। রাজনৈতিক দলগুলো মতাদর্শ ও সুযোগের ভিত্তিতে কোয়ালিশন গড়ে থাকে। ইউক্রেনের অন্তনির্হন রাজনীতি বিশ্বের অন্যতম দুই প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে :
ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতিতে যে সব ঘটনা আলোচনায় এসেছে, সেগুলো হল
১। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন
২। ২০০৪ সালের অরেঞ্জ বিপ্লব
৩। ২০১৪ সালের ডিজনিটি বিপ্লব বা ইউরোমেইডেন মুভমেন্ট
৪। ২০২০-২২ এ ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভূক্ত চেষ্টা এবং যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সামরিক উত্তেজনা
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গন :-
রাশিয়ান বলশেভিকদের হাত ধরে ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের চারটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের অন্যতম রাষ্ট্র ছিল ইউক্রেন। ১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ইউক্রেনের এই ঘোষণা সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনে একটি বড় ভূমিকা রাখে। এরই ধারায় বাকি ১৪-টি রাষ্ট্রও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
পশ্চিমাদের দাবি, ইউক্রেন একটি স্বাধীন জাতি ছিল এবং তাদের সাথে রাশিয়ার কোনো সম্পর্ক ছিল না। রাশিয়ায় ছিল একটি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দমনমূলক শাসন। আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে রাশিয়ান শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল।
পক্ষান্তরে রাশিয়র দৃষ্টিকোণ থেকে, উৎখাত করা সরকার ছিল ইউক্রেনের বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমাপন্থী সরকার এটি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য একটি অভ্যুত্থানের আয়োজন করেছিল। এভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে পুঁজি করে। অথচ ইউক্রেনে রাশিয়ানরা অষ্টাদশ শতকে সুইডিশ অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছিল যা মস্কো থেকে মাত্র ৮০০ কিলোমিটার দূরে।
২০০৪ সালের অরেঞ্জ বিপ্লব
১৯৯২ সালে সােভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের মাধ্যমে কোল্ড ওয়ারের সমাপ্তি ঘটে। এর পরপরই বিভিন্ন দেশগুলাতে রাশিয়া পন্থীদের প্রডাব থেকে মুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার প্রয়াস চালায় যার মধ্যে ইউক্রেন ছিল অন্যতম। এরই ধারায় ২০০৪ সালে ইউক্রেনে সংঘটিত হয়েছিল অরেঞ্জ
বিপ্লব। এই বিপ্লবের মূলমন্ত ছিল রাশিয়া
পন্থী নেতার পতন ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে ইউক্রেনবাসীরা রাজধানী কাইভ
এর ইন্ডিপে্ড্ট স্কয়ারে অবস্থান নেয়। এই বিপ্লবটি ছিল একটি রক্তপাতহীন বিপ্লব।
২০১৪ সালের ডিজনিটি বিপ্লব বা ইউরোমেইডেন মুভমেন্ট
অরেঞ্জ বিপ্লবের মাধ্যমে পশ্চিমা পন্থী সরকারের আগমন ঘটলেও ২০১০ সালে আবারও রুশপন্থী সরকার ভিক্টর ইয়ানকুচের আগমন ঘটে। তিনি ছিলেন ইউক্রেনের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট।
২০১৩ সালে ইউক্রেনের সাথে ইউরোপিয় ইউনিয়নের মুক্তবাজার অর্থনীতির একটি চুক্তিকে কেন্দ্র করে ইউক্রেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও জটিল আকার ধারণ করে। ২০১৪ সালে চুক্তিটি কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা রূপ নেয় সহিংসতায়। একে ডিজনিটি বিপ্লব বা ইউরোমেইডেন মুভমেন্ট বলে আখ্যায়িত করা হয়। বিরোধীদের প্রতিবাদের মুখে ভিক্টর ইয়ানকুচ শেষ প্রর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ন্যাটো অন্তর্ভুক্ত ও রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক উত্তেজনা।
ইউরোমেইডেন মুভমেন্টের মাধ্যমে ইউক্রেনে পশ্চিমা পন্থি সরকারের আগমন ঘটে। এমন কি, ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি ইউরোমেইডেনের অন্যতম সমর্থক ছিলেন। ২০১৯ সালে সেই ভ্লাদিমির জেলেনস্কি ইউক্রেনের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি ইউক্রেনকে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ঘোষণা দেন।
রাশিয়া এই ঘোষনার চরম বিরোধিতা করে। কারণ ইউক্রেন ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হলে রাশিয়া নিরাপত্তা ঝুকিতে পরতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেন সিমান্তে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার সৈন্য জড়ো করেছে। আগামীতে ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক সক্ষমতার প্রায় ৭০ শতাংশ প্রস্তুত করেছে রাশিয়া। ইউক্রেন আক্রমণ হলে ১০ থেকে ৫০ লাখ শরণার্থী পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারে।
অন্যদিকে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এই সপ্তাহেই ফ্রন্ট ব্রাগ, ক্যারোলিনা থেকে পোলান্ড এবং জার্মানিতে প্রায় দুহাজার সেনা পাঠাতে চলেছে এবং প্রায় এক হাজার জার্মানি বেস সেনাবাহিনীকে রোমানিয়াতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বুধবার এমনটাই জানিয়েছেন বাইডেন প্রশাসনের এক আধিকারিক।
ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে চলমান এই উত্তেজনা এখন কোন দিকে মোর নেয় তা এখন পর্যবেক্ষণের বিষয়।