জামায়াতের উত্থান ও পশ্চিমা বিশ্বের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
জামায়াতের উত্থান ও পশ্চিমা বিশ্বের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থি দলগুলোর উপস্থিতি নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই তারা কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যদি জামায়াত-ই-ইসলামী বা তাদের সমর্থিত সংগঠনগুলো জাতীয় রাজনীতিতে বড় প্রভাব বিস্তার করে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে (যেমন ডাকসু নির্বাচনে) ব্যাপক জয়লাভ করে, তবে এটি শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও একটি আলোচিত বিষয় হয়ে উঠবে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব এই ঘটনাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করবে, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কূটনীতি ও অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।
জামায়াতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
জামায়াত-ই-ইসলামী পাকিস্তান আমল থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ইসলামপন্থি দল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা বিরোধী অবস্থান ও পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধে সম্পৃক্ততার কারণে দলটির ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবুও বিএনপি শাসনামলে সরকারে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে তারা পুনরায় প্রভাব বিস্তার করে।
তবে ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের দণ্ডাদেশের পর দলটি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্বাচনে সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও তারা ছাত্রশক্তি ও সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রভাব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
পশ্চিমা বিশ্বের মূল উদ্বেগ
যদি জামায়াত বা তাদের সমর্থিত ইসলামপন্থি শক্তি ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়, তবে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি হবে সতর্ক। তাদের উদ্বেগের প্রধান বিষয়গুলো হতে পারে—
-
উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কা
- পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের জামায়াতকে প্রায়ই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ইসলামপন্থি জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে তুলনা করে দেখে।
- ২০০০–এর দশকে বাংলাদেশের জঙ্গি হামলাগুলোর সময়ে জামায়াতের সঙ্গে পরোক্ষ যোগসূত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
- তাই তারা ভয় পেতে পারে, রাজনৈতিক ক্ষমতায় এলে দলটি উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দিতে পারে।
-
মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার ও নারীর সমঅধিকার নিয়ে অবস্থান নেয়।
- জামায়াত অতীতে ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক নীতি প্রচার করায় পশ্চিমারা সন্দেহ করতে পারে যে ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু ও প্রগতিশীল মহলের অধিকার সংকুচিত হতে পারে।
-
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা
- বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী। যদি এখানে রাজনৈতিক ইসলাম শক্তিশালী হয়, তবে ভারতও উদ্বিগ্ন হবে এবং সেই চাপ পশ্চিমাদের উপরও পড়বে।
- আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা পশ্চিমাদের মনে করিয়ে দিতে পারে যে রাজনৈতিক ইসলাম অনেক সময়েই সশস্ত্র উগ্রবাদের দিকে গড়ায়।
সম্ভাব্য কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
-
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, তবে শর্তযুক্ত
- যদি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে জামায়াত বা তাদের জোট ক্ষমতায় আসে, পশ্চিমা বিশ্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল মেনে নেবে।
- তবে মানবাধিকার, সংখ্যালঘু নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানের ব্যাপারে কড়া শর্ত জুড়ে দেবে।
-
অর্থনৈতিক চাপ
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে বিশাল বাজার। তারা জিএসপি (Generalized System of Preferences) বা GSP+ সুবিধা মানবাধিকার শর্তের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে।
- যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ভিসা নিষেধাজ্ঞা বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো নীতি নিতে পারে।
-
বিকল্প শক্তিকে সমর্থন
- পশ্চিমারা সাধারণত একক কোনো দলের উপর নির্ভর করে না। যদি জামায়াত বড় শক্তি হয়ে ওঠে, তবে তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা সুশীল সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করবে, যাতে ভারসাম্য বজায় থাকে।
-
নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি
- সন্ত্রাসবিরোধী প্রোগ্রাম, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে পশ্চিমারা বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ বজায় রাখবে, যেন কোনো উগ্রবাদ মাথাচাড়া না দেয়।
ইতিবাচক দিকের সম্ভাবনা
পশ্চিমা বিশ্ব সবসময় ধর্মভিত্তিক দলকে নেতিবাচকভাবে দেখে না। যদি জামায়াত প্রমাণ করতে পারে যে তারা—
- গণতান্ত্রিক চর্চা মেনে চলে,
- সহিংসতা পরিত্যাগ করে,
- এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় আগ্রহী—
তাহলে পশ্চিমারা ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখবে। তুরস্কের আকালপ (AKP)-এর উদাহরণ তারা সামনে আনতে পারে।
উপসংহার
বাংলাদেশে ইসলামপন্থি জামায়াত যদি ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বড় প্রভাব বিস্তার করে, তবে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি হবে সতর্ক, শর্তযুক্ত ও কৌশলগত। তারা একদিকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান দেখাবে, আবার অন্যদিকে মানবাধিকার ও উগ্রবাদের ঝুঁকিকে সামনে রেখে চাপ প্রয়োগ করবে।
অতএব, জামায়াত বা যে কোনো ইসলামপন্থি দলের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হবে—নিজেদেরকে সহনশীল, গণতান্ত্রিক ও আধুনিক উন্নয়নমুখী শক্তি হিসেবে প্রমাণ করা। অন্যথায় পশ্চিমাদের চোখে তাদের উত্থান হবে শুধু উদ্বেগ আর প্রশ্নের বিষয়।