রুশ ও তুর্কি ওসমান সম্রাজ্যের বিরোধ
পঞ্চদশ হতে বিংশ শতাব্দীর মধ্যে তুরস্ক তথা উসমানীয় সম্রাজ্য ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো দা-কুমড়ার মত। উসমানীয় সাম্রাজ্য এবং রুশ সাম্রাজ্যে মধ্যে ককেশাস, বলকান, ক্রিমিয়ায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ডজনের উপর যুদ্ধ হয়েছিলো।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে কৃষ্ণ সাগর এবং তৎসংলগ্ন উপকূল সমূহ উসমানীয়দের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। কৃষ্ণ সাগরে স্বাধীনভাবে বাণিজ্য করার কোনো উপায় ছিলো না রুশদের। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে কয়েকটি যুদ্ধে উসমানীয়দের বিপক্ষে জিতার পরে কৃষ্ণ সাগরের তীরে যৎসামান্য ভূখণ্ড রুশদের নিয়ন্ত্রণে আসে। কৃষ্ণ সাগরের উপর সীমিত আকারে রুশরা অধিকার লাভ করে।
কৃষ্ণ সাগরের উপর আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ লাভ করার জন্য এরপর অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রুশরা।
পিটার দ্য গ্রেট, সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিনের রাশিয়া বিংশ শতাব্দীর আগেই কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণ উপকূল ছাড়া বাকি অংশটা থেকে উসমানীয়দের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়।
অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী বেশিরভাগ অঞ্চল তথা ক্রিমিয়া, মলদোভা ও ককেশাসের অঞ্চলগুলো উসমানীয় তুর্কীদের থেকে রুশরা নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। অথচ ক্রিমিয়া ও ককেশাস মুসলিম ও তুর্কীক অধ্যুষিত অঞ্চল ছিলো।
কিন্তুু এরপরেও তুর্কি উসমানীয়রা রুশদের চাপে রাখার জন্যে যথেষ্ট ব্যাবস্থা ছিল। আর তা হলো বসফরাস প্রণালি বন্ধ করে দিয়ে কৃষ্ণ সাগর কে অবরুদ্ধ করা এবং রাশিয়ার সবরকম বাণিজ্য থামিয়ে দেওয়া।
এজন্যই তৎকালীন রুশ সম্রাজ্য তুর্কি উসমানীয়দের বসফরাস ও দাদেনেলিস প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ নিতে ক্রমাগত হামলা করতে থাকে। তবে রুশরা বহুবার চেষ্টা করলেও বসফরাস প্রণালীর নগরী ইস্তাবুল দখল আর কখনোই সম্ভব হয়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মোটামুটি তুরস্ক এবং রাশিয়ার সীমানা ও বিরোধ একটা স্থিতাবস্থার মধ্যে আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত পক্ষে এবং রাশিয়া বিজয়ী পক্ষে ছিলো।
মিত্র পক্ষের শক্তি হিসাবে রাশিয়া তখন স্বাভাবিকভাবেই তার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা ইস্তাম্বুল নগরী দখল নেওয়ার দাবি জানায়।
কিন্তু অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিগুলো রাশিয়ার এই দাবি প্রত্যাখান করে এবং বৃহৎ ও কৌশলগত স্বার্থে ইস্তাম্বুলকে তুরস্কের অধীনেই রাখে।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর তুর্কির বসফরাস ও দার্দেনেলিস প্রণালী বিষয়ক দু'টি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি দুটি হলো লুজান চুক্তি এবং মনটেক্স প্রটোকল। লুজেন চুক্তির মাধ্যমে প্রণালীগুলোকে আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়। এর ফলে তুরস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ গুরুত্বপূর্ণ এই প্রণালীদ্বয়ের মালিকানা হাতছাড়া হয় তাদের।
কিন্তু ১৯৩৬ সালের মনটেক্স প্রোটোকলের মাধ্যমে প্রণালীদ্বয়ের মালিকানা আবারও তুরস্কের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে মালিকানা ফিরে দেওয়া হলেও তুরস্ককে ট্যাক্স নেওয়ার অধিকার প্রদান করা হয়নি। তুরস্ক শুধুমাত্র যুদ্ধকালীন সময়ে সামরিক জাহাজগুলোর চলাচল বন্ধ করতে পারবে এই প্রণালী দিয়ে। তুরস্কের জন্য এই প্রটোকলটি মন্দের ভালো ছিলো, অন্তত লুজান চুক্তির তুলনায়।
যুদ্ধকালীন সময়ে বসফরাস এবং দার্দানেলিস প্রণালীতে সামরিক যান নিয়ন্ত্রণের অধিকার তুরস্ক পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় রাশিয়া।
স্পষ্টতই তুরস্কের এই যৎসামান্য অধিকার ফিরে পাওয়াতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়ার সামরিক উচ্চাভিলাস কিছুটা চাপে পরে। কারণ, রাশিয়া যদি কখনো যুদ্ধ ঘোষণা করতে চায়, তবে অনেকাংশেই তাদের নির্ভর করতে হবে তুরস্কের উপর।
রাশিয়া তুরস্কের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে এবং কৃষ্ণ সাগরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ইস্তাম্বুল দখলের পরিকল্পনা নেয় । রাশিয়া থেকে এমন হুমকি আসার পর কিছুটা তটস্থ হয়ে পরে তুর্কী সরকার। আর তাই আধুনিক তুর্কী রাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তথা ১৯৫০ সালের আগ প্রর্যন্ত নিরপেক্ষ আন্দোলন এবং যুদ্ধ বিরোধী ইমেজ পরিত্যাগ করে । কিন্তু রাশিয়ার হুমকি মোকাবেলার লক্ষে ১৯৫০ এর দশকে তুরস্ক ন্যাটো'তে যোগদান করে। এতে করে রাশিয়ার ইস্তাম্বুল অভিযানের প্রয়াস হোচট খেয়ে যায়।
আমাদের পরবর্তি ভিডিওতে আলোচনা করা হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তথা বর্তমান সময়ে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের কৌশলগত অবস্থান এবং কৃষ্ণ সাগরীয় ভূ-রাজনৈতি। তাই সাবস্ক্রাইব ও বেল আইকনে ক্লিক করে চ্যানেল এন,আর,বি এর সাথেই থাকুন।