বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কেন বিরোধিতা করেছিল। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক।

 



বাংলাদেশে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম অংশিদার। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ব্যাপারে অনেকই প্রশ্ন করতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল? 

এর কারণ, ১৯৭১ সালে কোরিয়া যুদ্ধ, চীন- রাশিয়া সিমান্ত উত্তেজনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ ঘটে। কূটনীতিক ভাষায় এই মেরুকরণ কে বলা হয় পিং পং ডিপলোমেসি। 

পিং পং ডিপলোমেসির হাত ধরে সে সময় চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নতি হতে থাকে।  তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এর নেতৃত্বে চীনের সাথে এক নতুন সম্পর্কের ভিত্তি গড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর পিছনে কোরিয়া যুদ্ধ, চীনের সাথে রাশিয়ার বিরোধ, অন্যদিকে ভারতের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক উন্নয়ন কারণ হিসাবে দেখা যায়। 

ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে এতটাই সিরিয়াস ছিল যে, দির্ঘ দিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে উপেক্ষা করে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চিন্তা করেছিল। এমন কি, চরম মূহুর্তে যদি পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় বড় কোন পদক্ষেপ নেয়, পক্ষান্তরে ভারতও রাশিয়ার সাথে এক হয়ে এর জবাব দিবে।

এমন কিছু হলে ভারত ও বাংলাদেশের উপর রাশিয়া স্থায়িভাবে সমাজতন্ত্রের ভিত্তি গেড়ে বসত। এমন নাটকিয়ভাবে ভারতের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক উন্নায়ন এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের শক্ত অবস্থানের জবাব হিসাবে  যুক্তরাষ্ট্রও চীনের সাথে জোট করে ভারতকে চাপে রাখার জন্য।

এ কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ  উপমহাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা মূলত ভারতই দায়ী বলে মার্কিন প্রশাসন অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে জাতিসংঘের তরফ থেকে শান্তি বাহিনী প্রেরণের প্রস্তাব করে যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রস্তাবকে  একতরফা বলে ভেটো প্রয়োগ করে। এ প্রস্তাবে পোল্যান্ডও বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। ফ্রান্স ও ব্রিটেন ভোটদানে বিরত থাকে। 

এসব কারণে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার ব্যাপারে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন চুপ থাকে। তবে, আমেরিকার অনেক ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিক আইনপ্রণেতারাই 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের' বিষয়ে নিক্সনের হোয়াইট হাউজের সমর্থনের বিরোধিতা করেন। এদের মধ্যে হলেন  টেড কেনেডি, ফ্রাঙ্ক চার্চ ও উইলিয়াম বি. স্যাক্সবেসহ আরও অনেকেই। 

 অবশ্য ১৬-ই ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং সেই সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতি পূনর্গঠনের জন্য প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। 

বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় ৪৬ কোটি ডলার।  বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় দেড়শ কোটি ডলার পণ্য আমদানি করে আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫৭০ কোটি ডলার পণ্য রফতানি করে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র হতে খাদ্যশস্য,  ভুট্টা, কৃষি যন্ত্রপাতি, লোহা ও ইস্পাত জাতীয় পণ্য আমদানি করে।  অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ হতে তৈরি পোশাক,  জুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী ও কৃষি পণ্য আমদানি করে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। এক মার্কিন কূটনীতিকের মতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও গভির হওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি D-এর উপর নির্ভর করবে। এগুলো হল ডেমোক্রেসি, ডেভলমেন্ট এবং ডিনাইং স্পেস ফর টেররিজম। এই তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশ যত এগিয়ে যাবে, সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পাবে।  

তবে রানা প্লাজার দূর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের উপর যুক্তরাষ্ট্রের  জেএসপি সুবিধা স্থগিত করা এবং সাম্প্রতিক  মানব অধিকার ইস্যুতে র‌্যাব ও র‌্যাবের শির্ষ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বাংলাদেশের ভূমিকাই এই ক্ষেত্রে নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ-এ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে।


Theme images by duncan1890. Powered by Blogger.